সালমান শাহ: ২৯ বছর পরও রহস্যের শেষ নেই — আত্মহত্যা না হত্যা?
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সালমান শাহ এমন এক নাম, যিনি শুধু একজন অভিনেতা নন—তিনি এক প্রজন্মের ভালোবাসা, আকর্ষণ ও বিস্ময়ের প্রতীক। কিন্তু ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, হঠাৎ করেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। সেই দিন থেকেই শুরু হয় এক অন্তহীন প্রশ্নের পথচলা—
সালমান শাহ কি আত্মহত্যা করেছিলেন, নাকি তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল?
আদালতের নতুন আদেশে আবার আলোচনায় সালমান শাহ
প্রায় তিন দশক পর আবারও আদালতের নির্দেশে সালমান শাহর মৃত্যুর মামলা নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এবার তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা করার আদেশ দিয়েছেন আদালত।
এর আগে এটি ছিল অপমৃত্যু মামলা, যা নানা সময়ে সিআইডি, র্যাব ও পিবিআই তদন্ত করলেও কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি।
মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) রাজধানীর রমনা থানায় মামলাটি হত্যা মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। মামলায় ১১ জনকে নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন সালমানের স্ত্রী সামিরা হক, প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাই, অভিনেতা ডনসহ আরও অনেকে।
পরিবারের দাবি: এটি আত্মহত্যা নয়, হত্যাকাণ্ড
সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছেন যে, তাঁর ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে।
২০২১ সালে তিনি পিবিআইয়ের আত্মহত্যা রিপোর্টের বিরুদ্ধে “নারাজি” আবেদন করেন। চার বছর পর আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করে হত্যা মামলার নির্দেশ দেন। বর্তমানে লন্ডনে থাকা নীলা চৌধুরী জানিয়েছেন,
“এখন আমার একটাই চাওয়া—ছেলের হত্যার ন্যায়বিচার। প্রশাসন যেন নিশ্চিত করে, কেউ যেন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারে।”
যেভাবে শুরু হয় সালমান শাহর মৃত্যুর তদন্ত
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর ইস্কাটনের বাসা থেকে সালমানের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। প্রথমে পুলিশ অপমৃত্যু মামলা করে।
১৯৯৭ সালে সিআইডি তদন্ত শেষে জানায়, এটি আত্মহত্যা। কিন্তু সালমানের বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরী এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেন এবং হত্যা মামলা রূপে রূপান্তরের আবেদন করেন।
তদন্তের দায়িত্ব পরে একাধিকবার বদল হয়—সিআইডি থেকে বিচার বিভাগীয় তদন্ত, তারপর র্যাব, এবং সবশেষে ২০১৬ সালে পিবিআই।
২০২০ সালে পিবিআই জানায়, সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন। তাদের দাবি ছিল—
-
স্ত্রী সামিরার সঙ্গে দাম্পত্য কলহ,
-
চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা,
-
মানসিক চাপ ও সন্তান না হওয়ার হতাশা—এসব কারণে সালমান আত্মহত্যা করেন।
তবে পরিবার কখনোই এই ব্যাখ্যা মানতে পারেনি।
রিজভি আহমেদের স্বীকারোক্তি: নতুন মোড়
১৯৯৭ সালে রিজভি আহমেদ নামে এক ব্যক্তি আদালতে জবানবন্দি দিয়ে দাবি করেন, সালমান শাহকে হত্যা করে আত্মহত্যার নাটক সাজানো হয়েছিল এবং তিনি নিজেও সেই ঘটনায় জড়িত ছিলেন।
এই বক্তব্যের ভিত্তিতেই নতুন করে সন্দেহের জন্ম নেয় এবং এবার আদালত হত্যার মামলা গ্রহণের আদেশ দেন।
আসামির তালিকা
হত্যা মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন—
সামিরা হক, আজিজ মোহাম্মদ ভাই, লতিফা হক লুচি, অভিনেতা ডন, ডেভিড, জাভেদ, ফারুক, মে–ফেয়ার বিউটি সেন্টারের রুবি, আব্দুস ছাত্তার, সাজু ও রিজভি আহমেদ ফরহাদ।
এছাড়া অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকেও মামলায় আসামি করা হয়েছে।
বর্তমানে মামলাটির দায়িত্ব কোন সংস্থা নেবে, তা এখনো নির্ধারিত হয়নি।
সালমান শাহর মৃত্যুদিনের ঘটনার বর্ণনা
সেই শুক্রবার সকালে সালমানের বাবা ছেলেকে দেখতে গিয়েও দেখা পাননি। পরে বেলা ১১টার দিকে তাঁর মা নীলা চৌধুরী খবর পান, সালমান অসুস্থ।
দৌড়ে গিয়ে দেখেন, ছেলেকে তেল মালিশ করছেন কয়েকজন। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
ময়নাতদন্তে আত্মহত্যার আলামত পাওয়া যায়, কিন্তু পরিবার তা মেনে নেয়নি এবং দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের দাবি তোলে।
অবশেষে আবার সেই প্রশ্ন
২৯ বছর কেটে গেছে। বহু তদন্ত, অসংখ্য সংবাদ শিরোনাম, তবুও সালমান শাহর মৃত্যুর রহস্য উন্মোচন হয়নি।
নতুন করে হত্যা মামলা হয়তো এই রহস্যের নতুন অধ্যায় খুলবে, হয়তো আবারও দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা।
তবুও বাংলা চলচ্চিত্রের অমর নায়ক সালমান শাহ আজও বেঁচে আছেন কোটি ভক্তের হৃদয়ে।
আর তাঁর মৃত্যুর প্রশ্ন এখনো বাতাসে ঘুরে বেড়ায়—
এটা কি আত্মহত্যা, না হত্যা?
📰 সংক্ষিপ্ত তথ্যভিত্তিক সারাংশ
-
সালমান শাহ মারা যান: ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬
-
প্রাথমিক মামলা: অপমৃত্যু মামলা (রমনা থানা)
-
সর্বশেষ আদালতের আদেশ: হত্যা মামলা হিসেবে গ্রহণ (অক্টোবর ২০২৫)
-
আসামি সংখ্যা: ১১ জন
-
পরিবার দাবি: এটি আত্মহত্যা নয়, হত্যাকাণ্ড
-
তদন্তে জড়িত সংস্থা: সিআইডি, র্যাব, বিচার বিভাগ, পিবিআই

কোন মন্তব্য নেই